দেশ স্বাধীন হল। মমিন সাহেব তার চাকুরীতে পূণর্বহাল হলেন। জুট ডিপার্টমেন্টে কাজ করার সুদীর্ঘ অভিজ্ঞতা তার। তার চোখ ফাঁকি দিয়ে কোনদিনও একটা অযোগ্য আঁশ মিলের মেশিনে ঢুকতে পারেনি। কিন্তু স্বাধীন দেশে স্বাধীনভাবে কাজ করতে যেয়ে তাকে নতুন নতুন সব অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হল। যা কখনও তিনি কল্পনা করতে পারেননি, নিত্য তার কাজ করতে যেয়ে এমনি অদ্ভুৎ সব ঘটনা ঘটতে লাগল। এত বেশী পরিমান অযোগ্য ও পঁচা পাট আসতে শুরু করল, যে তিনি রীতিমত শংকিত হয়ে পড়লেন। প্রোডাকশনে দেবার মত পাট একেবারেই পাওয়া যাচ্ছে না। প্রোডাকশন বন্ধ হওয়ার উপক্রম। দেশে কি তাহলে ভাল পাট হচ্ছে না ? কিন্তু এ হতে পারে না। তাহলে এসব হচ্ছে কী? এদিকে পাটের সরবরাহকারীরা তাদের মালামাল রিজেক্ট হওয়ার কারনে ক্ষুব্ধ হয়ে ম্যানেজারের দ্বারস্থ হলেন। অগত্যা ম্যানেজার সাহেব তাকে তলব করলেন।
* আচ্ছা, মমিন সাহেব, আপনাকে এ্যাডমিন অফিসার একটা অফিস অর্ডার দিয়েছে না ?
- জ্বী, স্যার ।
* সেটা আপনি পড়েছেন ?
- হ্যা ।
*আপনার কার্যকলাপ দেখে তো মনে হচ্ছেনা, আপনি তা পড়েছেন । আপনি ম্যানেজমেন্টের কোন আদেশই পালন করছেন না। - ঠিক বুঝতে পারলাম না।
* বুঝতে পারলেন না ? নাকি না বোঝার ভান করছেন ? আপনি নাকি মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন ?
- সেত বটেই।
* কিন্তু, আপনার কাজে কর্মেতো তা মনে হয় না। আমার তো মনে হচ্ছে আপনি রাজাকার ছিলেন। পাকিস ানী আমালাদের মত জট পাকাচ্ছেন। সব আটকে দিয়েছেন, মিলে পাট ঢুকছেনা, লোকজন বিল পাচ্ছেনা। প্রোডাকশন বন্ধ হয়ে আছে। চিঠিটাত বাংলায় লেখা, না কি? আপনি যদি বুঝতে না পারেন, তাহলে এ্যাডমিন অফিসার এর কাছ থেকে বুঝে নেন নি কেন?
- আমি অত্যন বিনীতভাবে আপনাকে বলছি স্যার, এতক্ষন আপনি যা বললেন, তা সঠিক নয়। কোয়ালিটি সমপন্ন পাট যা আসছে তা প্রবেশ করছে তবে এবার যেন কী হয়েছে স্যার, পাট যা আসছে তা একেবারেই পচা, ভিজে । কোন অবস্থাতেই তা প্রোডাকশনে দেবার মত নয়। কিন্তু কোন্ আদেশ আমি পালন করছিনা- এটা আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। নেচারালী দায়িত্ব পালনে আমার ভুল হবার কথা না।
রেগে ফায়ার হয়ে গেলেন তার কথা শুনে। কলিং চেপে -
* এ্যাডমিন অফিসারকে নতুন অফিস আদেশের ফাইলটা নিয়ে আসতে বল
কিছুক্ষন পর এ্যাডমিন অফিসার ফাইলটা নিয়ে এলেন ।
* নতুন আদেশটা বের করুন ।
-- এই যে, স্যার ।
* এটা উনাকে দেয়া হয়েছে ?
-- হ্যা, স্যার ।
* কিন্তু উনি নাকি এ চিঠির ভাষা কিছু বুঝতে পারছেন না। উনাকে ভাল করে বুঝিয়ে দিন। আর সে ভাবে কাজ করে দ্রূত ব্যবস্থা নিন । এক ঘন্টার মধ্যে আমাকে রিপোর্ট দিন।
-- আচ্ছা, স্যার। মমিন সাহেব, আসুন আমার সংগে।
বোকার মত তার সাথে তার কক্ষে গেলেন।
-- কী আশ্চর্য! আপনি এর কী বুঝতে পারেন নি, বলুন তো?
* শোনেন, এও সাহেব, আমি কচি খোকা নই।
-- তা হলে সমস্যা কোথায় ?
* সেটাত আমারও প্রশ্ন, সমস্যা কোথায় ?
-- শোনেন, আপনার সমস্যা আমি বুঝতে পেরেছি। দেখুন, ওপরের নির্দেশ। এখন আপনাকে পাটের গাইট খুলে আর চেক করতে হবে না। আপনি শুধু নির্দ্ধারিত ছকে আপনার ডেজিগনেশন কলামে সিগনেচার করে দেবেন। পার্টি তার পেমেন্ট পেয়ে যাবে। দ্রূত প্রোডাকশন হবে। এ চিঠির সার কথাত তাই নাকি ?
* হ্যা, কিন্তু আমি যে কলামে স্বাক্ষর করব সেখানে কী লেখা আছে ? সেখানে লেখা আছে
- ঈযবশবফ ্ ঋড়ঁহফ জবয়ঁরৎবফ য়ঁধষরঃু - আপনার কি তা জানা আছে ?
-- আরে, ভাই, আমি জানি তো
* তাহলে চেক না করেই সঠিক মানের পাওয়া গেল এমন একটা সার্টিফিকেট আমি দিব কিসের ভিত্তিতে?
-- আপনি আসলে একটা বোকা। আপনি সার্টিফিকেট দিবেন ম্যানেজারের স্বাক্ষরিত এ আদেশের ভিত্তিতে। আপনার এখানে কোন দায় দায়িত্ব নেই। সব দায় দায়িত্ব ম্যানেজমেন্টের। এখন বুঝেছেন ?
* হ্যা, পরিস্কার। তবে আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা। অস হাতে নিয়ে যুদ্ধ করে মরতে মরতে বেঁচে এসেছি। আর ম্যানেজার আমাকে বলেন, আমি নাকি রাজাকার। আমারতো মনে হচ্ছে নিতাই বাবু নিজেই রাজাকার ছিলেন। নইলে এমন আদেশ উনি করলেন কি করে ? আমি এমন দায়িত্বজ্ঞানহীনের মত কাজ করতে পারি না। পাটের গাইট খুলে চেক না করে সঠিক মানের পাওয়া গেল -এমন একটা সার্টিফিকেট আমি দিতে পারি না। এটা নীতি নৈতিকতা বর্জিত কাজ। এত বড় অন্যায় আমি করতে পারি না। পরবর্তীতে কোন সমস্যা হলে আমার জন্য বিব্রতকর হতে পারে। আমি যা করছি, সঠিক কাজই করছি। পচা পাট কখনওই জবয়ঁরৎবফ য়ঁধষরঃু সমপন্ন হতে পারে না। আমার মনে হচ্ছে, এসবই ঐ ম্যানেজারের চক্রান । ওরতো এপারে কিছু নেই। সবই ওপারে। এ লোক সব উজাড় করে দিয়ে ইন্ডিয়া চলে যাবে। অকুলে ভাসব আমরা। এ অন্যায়। এ,ও সাহেব, এসব হতে দেবেন না। দেশের এমন সমপদ নষ্ট করার কোন অধীকার নেই আমাদের।
-- চুপ, চুপ, মমিন সাহেব, দেয়ালেরও কান আছে। আপনি আসলে বোকা। এসব কি আমরাও বুঝি না? আপনিত চাকরী হারাবেন, মিয়া। জানেন, ম্যানেজার নিজেও বলছে, তার নাকি কিছুই করার নেই। এসব নাকি ওপরের নির্দেশ।
* এ ওপরটা আসলে কে?
-- আপনি যান তো, নিজের চাকরীও খোয়াবেন, আমারটাও খাবেন। এ বাজারে চাকরী গেলে বাঁচব ?
* ছি ! ছি! আপনারা কি মানুষ? এত বড় অন্যায় ..............
-- আপনি যানত, ভাই। আপনি যা পারেন, তাই করেন । আমার যা বলার তা বললাম, আপনি যা ভাল মনে করেন।
এর পর দ্রূত প্রোডাকশন আর জনগনের বিল না পাওয়ার বিড়ম্বনা থেকে নামকরা জুট মিলকে উদ্ধার করার স্বার্থে মমিন সাহেবকে তার আসন ছেড়ে দিতে হয়েছিল। শুধু তাই নয়, ম্যানেজমেন্টের সাথে অসদাচরন এবং কাজে অযোগ্যতার অভিযোগে তাকে চিরদিনের জন্য মিল থেকে বিদেয় নিতে হয়েছিল।
এই আনফিট মমিন সাহেবের ছোট ছেলে পান্থকে বাস বতার কাছে পরাজয় বরণ করে শেষতক ৩য় শ্রেণীর একটা সরকারী চাকরীতেই নিয়োজিত হতে হল । দু'যুগ ধরে তার মায়ের অশ্রুজলে ভাসা বুকে স্বপ্নের বালুচর জেগে উঠবে- এমনটা আশা করেছিল হতাশাগ্রস্থ, বিদ্ধস এ পরিবারের সবাই। কিন্তু সব আশা ধুলিস্যাৎ হয়ে গেল। সব হিসেবের অংক গরমিল হয়ে গেল। দৈন্যতার করাল গ্রাসে তার জীবণ থেকে উচ্চ-শিক্ষার আলো দ র থেকে দ র হতে হতে ক্ষীন হয়ে আসছে। এভাবেই কেটে গেল আরো দশটা বছর। অনেক না পাওয়ার বেদনায় জর্জরিত এ মহীয়সী কোন এক রাতে রাগে, দুঃখে পান্থকে বকতে শুরু করলেন।
"তুই একটা মিথ্যাবাদী। প্রতারক। তুই আমার সাথে প্রতারনা করছিস। আমাকে বোকা পেয়েছিস ? ভেবেছিস, আমি কিছুই বুঝিনা? তোর বাপ সারা জীবণ আমাকে বোকা বানিয়ে রেখেছিল। এখন তুইও তোর বাপের কৌশল অবলম্বন করে আমাকে বোকা বানাবার চেষ্টা করছিস। আমার হাড়-মাংস সব ঝলসে গেছে, আমি আর সহ্য করতে পারছিনা। রকিব আর তুই এক সাথে চাকরীতে জয়েন করলি - অথচ দেখতে দেখতে সে এই দশ বছরের মধ্যে বাড়ি, জমি-জমা - কী না করেছে? আর তুই ? অপদার্থ কোথাকার । তুই আসলে অপদার্থ না। তুই হচ্ছিস একটা ধুর্ত শেয়াল। রকিব পারে আর তুই পারিস না ? তোরা আমাকে আর কতকাল বোকা বানিয়ে রাখবি ? তোর বাপ আমাকে সারাজীবণ জ্বালিয়েছে। সে তার চাকরী জীবণে কিছুই করতে পারল না। এমনকি ছোট্ট এ সংসারটাও ঠিকমত চালাতে পারেনি। তার এ ব্যর্থতার দায় সে ঢেকেছে নীতি আর আদর্শের কথা বলে। আমি তার নীতিবাক্যগুলোকে সান নার বানী মনে করে একবুক আশা নিয়ে কত দুঃখ কষ্টের সাগর পাড়ি দিয়ে তোদেরকে লেখাপড়া শিখিয়েছি। কত আশা, তোরা মানুষ হবি, ভালো একটা কিছু করে আমার দুঃখ কষ্টের দিনগুলোর বোঝাকে হাল্কা করে দিবি। কিন্তু হায় ! সবই আমার পোড়া কপাল। আমার কপালে আল্লাহ সুখ লেখেনাই। এ বয়সে এসে এত যন না ! বাবা, আমি আর সহ্য করতে পারছি না। তোর বাবার মত তোরও 'ব্যর্থ জীবণ' আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারছিনা। সত্যি করে বলত, তুই কি ভাবছিস ? বাবা মা এখন অচল, কদিনই বা বাঁচবে? তাই তাদের পিছে টাকা খরচ করে ফায়দা কী? তাই বুঝি তুই সংসারের অভাব অনটনকে কেবল নীতি আদর্শের দোহাই দিয়ে নিজেও সবার কষ্টের সাথে শরিক হচ্ছিস, আমাদেরকেও তিল তিল করে মারতে চাচ্ছিস ? নাহলে তুই টাকা করিস কি ? তোকে সবাই তোর বাবার মত অপদার্থ বলে, কেন? লোকের মুখে তোর এ সমালোচনা আমি আর সহ্য করতে পারছি না। তোরা আমাকে আর কতকাল জ্বালাবি? ... একটু দম নিয়ে আবার একটা দীর্ঘস্বাস ছেড়ে বললেন, আমার জীবণতো শেষ বাছা, এখন কেবল চোখ বোজার অপেক্ষায়। জানিনা তোদের মনে কী আছে। তবে দোওয়া করি, তোরা যেন আমার মত অর্ধাহারে -অনাহারে কষ্ট না পাস। এ আমার পেটেরই দোষ। যত সব অপদার্থ পেটে ধরেছিলাম''................ মায়ের কাছ থেকে নিত্য এরকম বকুনী শুনতে পান্থ অভ্যস্থ হয়ে গেছে। মায়ের কথার কোন জবাব দেয়না।
কত বড় আশা নিয়ে স্বাধীন দেশের মাটিতে ফিরে এসেছিলেন জীবিত মুক্তিযোদ্ধারা। ফিরে পাওয়া চাকরীতে জয়েন করে কতনা সুখী হয়েছিলেন মমিন সাহেবরা। সেই টানাটানির সংসারটা ধীরে ধীরে সুখ শান িতে ভরে উঠবে- এই একচিলতে আশা ! অথচ সততা আর নিষ্ঠার এই কি পুরস্কার !
স্বামীর বেকার ও প্রতিবন্ধী জীবণের হাল ধরলেন পান্থর মা। নিজে বিভিন্ন বাড়িতে ছেলে মেয়েদের কোরআন শিখিয়ে অল্প বিস র আয় করতেন। আর বাপের বাড়ি থেকে পাওয়া যৎসামান্য সাহায্য নিয়ে তিল তিল করে সংসারটাকে হাটি হাটি পা পা করে এগিয়ে নিয়ে এসেছেন। বড় ছেলে তুহিন অভাবের তান্ডব সইতে না পেরে দশম শ্রেণীতে পড়াকালে বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে পুলিশের চাকরীতে ঢুকে সংসারের হাল ধরল। তবে সেও যুগের সাথে তাল মিলিয়ে স্রোতে গা ভাসিয়ে দেয়ার মত পুলিশ হতে পারেনি। পারবেই বা কিভাবে? বাবার রক্ত আছে না শরীরে ? এত সেই আনফিট রক্ত । তার এ চাকরী নেয়াতে তার মা খুশী হলেন না। তিনি চেয়েছিলেন নিজে যুদ্ধ করে সন ানদের লেখা পড়া শিখিয়ে মানুষ করতে। তবে মা আহত হলেও সে দুর্দিনে তুহিনের অবুঝ দু'টো হাতের রোজগারের টাকায় সংসারের চাকা কিছুটা হলেও সচল হয়েছিল। এভাবে সময়ের চাকা আরো কয়েক পাক ঘুরেছে। স্বাধীনতার পরে জন্ম নেয়া ছোট মেয়েটাও এখন আর ছোট নেই, কলেজে পড়ছে। চার-ভাই বোনের সংসারে মায়ের চোখে কত স্বপ্ন। পান্থ অনেক বড় হবে, ভাল চাকরী করবে, বোন দুটোর ভাল বিয়ে দেবে। কিন্তু তুহিনের আয় রোজগারেতো তার নিজেরই পেট চলেনা। সংসারে যে অভাব অনটন, টানা পোড়েন চলছিল- তেমনই রইল। এ পোড়া সংসারে এর আর কোন ব্যতিক্রম হলনা। কেননা বেতনের সাথে বাজার দরের বিরাট বৈষম্য । কোন হিসেব মেলেনা।
মমিন সাহেবের যখন চাকরী ছিল, তখন পান্থদের বাড়িতে কিছু আংক্লদের আসা যাওয়া ছিল। যারা তার বাবার সততার প্রশংসা করতেন। আর জমিয়ে চায়ের আড্ডা বসিয়ে তাকে প্রেরণা যোগাতেন। তবে তারা তাকে সমাজের সাথে খাপ খাইয়ে নেয়ারও সাজেশন দিতেন। কিন্তু নাছোড় বান্দা মমিন সাহেব অন্যায়ের সাথে আপোশ করতে পারেন নি। এজন্য তার বন্ধুরা তাকে নিয়ে ঠাট্টা মশকরা করতেন। তিনি যখন চাকরী হারা হয়ে পংগুত্ব বরণ করেছেন তখন থেকে এসব আংক্লরা আর এ বাড়ির ত্রিসীমানা মাড়াতেন না। পাছে অসহায় হাতগুলো সাহায্যের জন্য বাড়িয়ে দেয়, এই ভয়ে। কিন্তু বাতাস কানে কানে বলে দিয়েছে ও সংসারটা এখনও ধ্বংস হয়নি। তারা জেনেছে ওদের ছেলে দুটো রাজকীয় চাকরী করে। সরকারী চাকরী। সমাজে ইতোমধ্যে ব্যাপক সাড়া পড়ে গেছে, সরকারী চাকরী- সে যে কোন শ্রেণীর হোক না কেন, কী এক যাদুর ছোঁয়ায় এদের রাজ কপাল খুলে যাচ্ছে। এরা রাতারাতি নিজেদের অবস্থাকে বদলে ফেলে দিতে সক্ষম হচ্ছে। তাই সে পরিবর্তনের হাওয়া মমিন সাহেবের বিদ্ধস সংসারে কতটা লেগেছে তা আঁচ করার জন্য হালে দু'একজন আংক্ল এ বাড়িতে আসা যাওয়া শুরু করেছেন।
* মাশ্-আ-আল্লাহ্! ভাবীর তো এখন দুঃখের দিনের অবসান হয়েছে, তাই না? ছেলেদের রাজকীয় চাকরী!
দীর্ঘশ্বাস ফেলে পান্থর মা বলেন,
- আমার কপালে কি আর সে সুখ আছে ভাই ? আমি আগেও যা ছিলাম, এখনও তাই।
* না, না, ভাবী। মমিন ভাইয়ের কথা বাদ দিন। উনিতো আসলে বোকা ছিলেন। আমরা কত বুঝিয়েছি ওনাকে । কোনদিন কি শুনেছে আমাদের কথা ? তবে আপনার ছেলে দুটো মাশ্-আ-আল্লাহ্! এ যুগের ছেলে না? ওরা ঠিকই আপনার ভাগ্যের পরিবর্তন করে দেবে। আপনি দেখে নিবেন।
- আরে ভাই, বাশের গোড়া দিয়ে কি কাঠাল গাছ হয় নাকি, ওরা ওদের বাবার ছেলে না?
* সে যা হোক, ওরা বুদ্ধিমান । ওরা ওদের বাবার মত ভুল করবে না।
- কী যে ভুল, আর কী যে সঠিক - এ রহস্য আজও জানতে পারলাম না। তবে আমি এ বুঝেছি, এ জনমে আমার কপালে আল্লাহ সুখ লেখেন নাই।
এসব আংক্লরা প্রায়শঃই এখানে এসে এসব গাল গপ্প করুক তা পান্থর একেবারেই পছন্দ না। কেননা তারা যে আশায় এখানে ঘুর ঘুর করে তা কোনদিনই পান্থর পক্ষে মেনে নেয়া সম্ভব না। সমাজের ভয়াবহ বিকৃত পরিবর্তনের ধরন ও ভাষা বোঝার মত কোন জ্ঞান সে অর্জন করতে পারেনি । তার বাবার রক্ত তাকে টেনে ধরে। মাঝে মাঝে তার মন বলে এদের জবাব দিতে। কিন্তু তার বাবার বন্ধুগণ, গুরুজন। তাই কিছু বলতেও পারে না। এদের কথা শুনে যে পান্থর মা তার ছেলেদের অবম ল্যায়ন করে কথা বলে, পান্থ তা মনে করে না। সে বুঝতে পারে ওরা এখানে এসে কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দিক তা তার মাও পছন্দ করেন না। তবে একবার তার বাবার কলিগ রহিম চাচা আর তার এক বন্ধু তাদের বাসায় এসে চায়ের ফাঁকে ফাঁকে চিবিয়ে চিবিয়ে যেসব কথা বললেন, তাতে এদের ভেতরের আসল রূপটা বেরিয়ে পড়ল।
* বড়টা না হয় পুলিশের সেপাইয়ের চাকরী করে, তার কথা না হয় বাদ দেয়া যায়। কিন্তু ছোটটা ? ওকে তো দেখে ব্রিলিয়েন্ট মনে হয়। চেয়ার টেবিলের চাকরী। প্রোমোশনের সুযোগ আছে। কত কি ব্যবস্থা আছে ওদের দপ্তরে! দেখনা, রকিবকে । রাতারাতি চেহারাই পাল্টে দিয়েছে তাদের পরিবারের। নাহ্, এ ছেলে আসলে ওর বাবার মত অপদার্থ। মনে অনেক স্বপ্ন নিয়ে এসেছিলেন, হয়তো মেয়েটাকে সুপাত্রস্থ করা যাবে। কিন্তু বাস্তব অবস্থা বিচার কওে ভাবলেন, বাঁচা গেল বাবা। মস বড় একটা ভুল হতে যাচ্ছিল। চা বিস্কুট খাওয়ানোর জন্য ভাবীকে অনেক ধন্যবাদ জানিয়ে রহিম চাচা তার বন্ধুকে নিয়ে দ্রুত বিদেয় হলেন। এর পর থেকে এবাড়িতে এদের আসা-যাওয়াটা বন্ধ হয়ে গেছে।
এভাবেই গড়িয়ে গেল আরো ক'বছর। পান্থ চাকরীর ফাঁকে ফাঁকে লেখা পড়াটা চালিয়ে নিয়ে কোনরকমে গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করে মাকে কিছুটা শান না দিতে পেরেছে। বিভাগীয় পরীক্ষাতেও পাশ দিয়ে পদোন্নতি পেয়েছে। অনেক শুকরিয়া। কিন্তু বেতন কাঠামোর সাথে বাজার দরের যে বৈষম্য- সে কষাঘাত থেকে মুক্তি পায়নি আজও। এদিকে কোন এক সহৃদয় ব্যক্তি পান্থর বাবার জীবণের ইতিহাস শুনে তার এক মেয়েকে তাদের পুত্রবধু করে নিয়ে গেছেন। এতে তাদের সংসারে তিনি একটা টাকাও খরচ করতে দেননি। এরই জের ধরে আর এক বন্ধু আর একটা মেয়েকেও তার পুত্রবধু করে নিয়ে গেছেন। এমন দৃষ্টান এ সমাজে সত্যিই বিরল। এ নেহায়েতই আল্লাহ্ তা'য়ালার অসীম কৃপা। মমিন সাহেবকে যারা মনে প্রাণে ভালবাসতেন, তারা বলেন, এটাই হচ্ছে আল্লাহ্র পক্ষ থেকে তাকে দেয়া তার সারা জীবণের ভাল কাজের নগদ পুরস্কার । মায়ের ইচ্ছেতেই অনিচ্ছা স্বত্ত্বেও বিয়ে করেছে সে। মা বলেছেন, তার বৌ নাকি তার জীবণের দুঃখের সাথী হয়ে চলার যোগ্যতা রাখবে। তার জীবণে তার বাবার চেয়ে বেশী কিছু উন্নতি হবেনা - এটা এখন সবার কাছে ধ্রূব সত্য। তাই বলেত জীবণ থমকে যাবে না।
পান্থ ঘরে বাইরে সবার কাছে আজ এক উপহাসের বস্তুতে পরিণত হয়েছে। তার বাবাকে লোকে পাগোল বলে, তাকেও বলে। এতে সে বিচলিত হয় না। তথাকথিত এ আনফিট লোকের সন ান হয়ে দুনিয়াতে আসার জন্য সে আল্লাহ্র দরবারে শুকরিয়া আদায় করে। তার মা এখন খুবই অসুস্থ্য। সারা জীবণে এতটুকু সুখ পেলেন না এ রমনী। তা নিয়ে তার কোনদিন আফসোস ছিল না। শেষ বয়সে এসে ছেলে মেয়েদের জীবণটাও তার বাবর মত অন্ধকার দেখতে পেয়ে আজ তিনিও ভারসাম্য হারাতে বসেছেন। তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে ভাতের থালার পরে -
ঝনাৎ করে প্লেট মেঝেতে পড়ার শব্দ কানে এলে মায়ের ঘরের দোরে এসে মাথাটা নীচু করে দাড়াল পান্থ।
** রোজ রোজ কি কলার মোচা আর পিপ্ল শাক দিয়ে ভাত পেটে যায় ? আর তো সহ্য হয় না। আল্লা এত মানুষ দুনিয়া থেকে নেয়, আমাকে চোখে দেখে না? এ পোড়া জীবণটা নিয়ে আল্লা আমাকে মুক্তি দেয় না ক্যান্ ?
চোখ দুটো গরম জলে ঝাপসা হয়ে আসে পান্থর। ভেতরে যাবার সাহস হলনা। নিঃশব্দে ফিরে আসে নিজের রুমে। কিইবা করার আছে। তার বাজেটে এর চেয়ে বেশী কিছু বরাদ্দ যে নেই। রকিব আর তার মাঝে কেন এ ব্যবধান, কেন সে অপদার্থ, এতসব বিশ্লেষন করে মাকে বোঝানোর মত সামর্থ তার নেই। এসব কথা শোনার মত মন মানসিকতা তার এ বয়সে থাকার কথাও নয়। তাই সব জ্বালা তার অন রেই লুকিয়ে থাক। মায়ের ঘর থেকে এসে নিজের ঘরে এসে চোরের মত শুয়ে পড়ল। রাত বাড়ছে। পান্থর বড় ছেলেটা "ক" থেকে "ম" পর্যন লেখা দেখিয়ে কিছুক্ষন আগে ঘুমিয়ে গেছে। চার মাস বয়সের ছোট ছেলেটা তার মায়ের শুকনো বুকে মুখ গুজে চুষছে আর থেকে থেকে না পাওয়ার বেদনায় চিৎকার করছে। আস ে করে গিনি্নকে বলল,
* বাচ্চাটার মাথার হাড় কেমন জেগে যাচ্ছে দেখেছ ? দুধের যে দাম ! আচ্ছা, আমি কি বদলে যাব ?
- বদলে যাবে, মানে ?
* এই যেমন ধর, আমাদের অফিসের কোন কোন জায়গায় কিছু কিছু টেকনিক্যাল সিষ্টেম আছে। বড় স্যারের হাতে পায়ে ধরে ওখানে যদি বদলী হতে পারি তাহলে আমার এ অপদার্থ নামের কলংক থেকে মুক্তি পেতে পারি। বাচ্চার দুধ কেনার টাকাটা, মায়ের জন্য মাছ , তোমার জন্য কিছু অলংকার, রোজকার বাজার খরচাটা. . . . . .আর কথা বাড়তে না দিয়ে গিনি্ন তার কংকালসার হাতখানা বাড়িয়ে স্বামীর ঠোট দুটো চেপে ধরে বলল, ছি ! এটুকু অহংকারই আমার অলংকার। আমি তোমার কাছে আর কিছু চাই না । কেবল আমার এ অহংকারটুকু তুমি ভেংগে দিওনা।
* কিন্তু, রোজ রোজ মায়ের বকুনী খেতে তোমার ভাল লাগবে?
- খু-উ-ব ভাল লাগবে । এই আমার সুখ। এখন তুমি ঘুমাও। যা এতক্ষন ভেবেছ, তার জন্য তওবা করে ঘুমোবে এস। স ীর এ কথায় বোকার মত ফ্যাল ফ্যাল করে তার মুখের দিকে কিছুক্ষন চেয়ে থাকল। দু'চোখের পাতা ঝাপসা হয়ে গেল। এত যন নার পরেও তার হৃদয়ে কী রকম এক সুখের ছোঁয়া দোলা দিয়ে গেল। "এ কেমন সুখ !"
চোখ মুছে মায়ের ঘরের দরজায় মাথা ঢুকিয়ে দেখে, বাতিটা তখনও জ্বলছে। খাটের পাশে যেয়ে অপরাধীর মত দাঁড়াল। দেখল, মায়ের কপোলের দু'ধারে গড়িয়ে পড়া অশ্রুরেখা শুকিয়ে চিক্ চিক্ করছে।